7.4.09

Dilara Zaman

যদি কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে না পারতাম তাহলে নিশ্চিত মারা যেতাম : দিলারা জামান

DilaraZaman00দীর্ঘদিন ধরে অভিনয় করে চলেছেন দিলারা জামান। এবারের আয়োজন এই প্রবীন অভিনেত্রীর সঙ্গে নানা প্রসঙ্গে কথোপকথন। যার সূত্রধর তানভীর সুপ্রিয়।


আপনি তো গিয়াস উদ্দিন সেলিমের 'মনপুরা' ছবিতে অভিনয় করেছেন। এই ছবি এবং আপনার অভিনীত চরিত্র সম্পর্কে বলুন।

'মনপুরা' গ্রামবাংলার একটা ছবি। এই ছবিতে সবাই-ই খুব ভালো কাজ করেছে। প্রথাগত নায়ক-নায়িকা নির্ভর ছবি নয় 'মনপুরা'। চঞ্চল (চঞ্চল চৌধুরী-ছবির অন্যতম চরিত্রাভিনেতা) দারুণ কাজ করেছে ওখানে। ছোট পর্দার ছেলেমেয়েরাই মূলতঃ পুরো ছবিটির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছে। এই ছবিতে আমি এক গানের দলের 'বুড়ি' চরিত্রে অভিনয় করেছি। ওখানে একটা গানের সাথে মুখও মিলিয়েছি। খুব কঠিন ছিল কাজটি। রাতে দুটো পর্যন্ত চেষ্টা করতে হয়েছে। কৃষ্ণকলির গান ছিল ওটা।

এই ছবিতে তো অনেক তরুণের সাথে কাজ করেছেন। কেমন কাজ করে তারা?

নতুনরা অনেক ভালো অভিনয় করে। ওরা এখন অনেক কিছু শিখে মিডিয়ায় আসছে। আমাদের সময় তো এত সুযোগ ছিল না। আমি বলব, তরুণরা আমাদের চেয়ে ভালো অভিনয় করছে। আমি মনে করি, ওরা আমার থেকেও ভালো অভিনয় করে!

'মনপুরা' কেমন সাড়া ফেলবে?

আশা করি, খুবই ভালো সাড়া জাগাবে। গিয়াস উদ্দীন সেলিম খুবই ভালো নির্মাতা হিসেবে নাম করতে পারবে।

আর কোন কোন ছবিতে অভিনয় করেছেন?

DilaraZaman01 'মনপুরা'-তে তো অভিনয় করলাম। এছাড়াও সরওয়ার ফারুকীর 'ব্যাচেলর'-এ অভিনয় করেছি। এই ছবিটা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের 'আগুনের পরশমনি'-তে কাজ করেছি। মুরাদ পারভেজের 'চন্দ্রগ্রহণ'-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছি। এই সিনেমায় আমরা সাতক্ষীরা ও খুলনার মাঝামাঝি জায়গায় শুটিং করেছিলাম। শুটিং উপলক্ষে ওখানে মেলা বসেছিল। মজার ব্যাপার হলো, ঐ ছবিতে অভিনয়ের প্রয়োজনে চুলের জটা ধরে রাখতে চম্পা ৫ কী ৬ দিন গোছল করার সময় মাথা ভিজায়নি।

আপনি তো মঞ্চেও কাজ করেছেন...।

মঞ্চে কাজ করেছি প্রথম জীবনে। চট্টগ্রামের 'অরিন্দম' নাট্যগোষ্ঠীতে অনেকদিন কাজ করেছি তখনকার বিখ্যাত অভিনেতা সদরুল পাশা তখন বেঁচে ছিলেন। আমি তার সঙ্গে ঐ দলে কাজ করেছি। আমার অভিনীত 'রাইফেল' নাটকটি বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। ঔ নাটকের গল্পটা এমন- এক ছেলে যুদ্ধে মারা গেলে অন্য ছেলেকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে চাই আমি। কিন্তু আর্মির গুলিতে মারা যায় সে। তখন রাগে-জেদে আমি নিজেই রাইফেল হাতে তুলে নেই এবং যুদ্ধে যাই। ভিয়েতনামের যুদ্ধ নিয়ে নাটকের এই গল্পটা তৈরি হয়েছিল। এছাড়াও '৭৯ সালে শিল্পকলা একাডেমীতে আমি একটি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছি। এটা ছিল হাসনাত আবদুল হাইয়ের লেখা 'সামনে যাই থাক ট্রেন চলবেই' নামের নাটক। ওই সময় আমিই ছিলাম একমাত্র মহিলা নির্দেশক। খুব সমাদৃত হয়েছিল নাটকটি।

মঞ্চ থেকে দূরে আছেন কত দিন?

মঞ্চ থেকে দূরে আছি অনেকদিন। '৮১ সালে যখন আবার ঢাকা আসি তখন আমার বাচ্চারা ছোট ছিল। তাই থিয়েটারে আর কাজ করা হয়নি। অনেকেই বলেছিল, থিয়েটারে যোগ দিতে। কিন্তু কোনো নাটকে অভিনয় করতে ২ থেকে ৩ মাস পর্যন্তও অনুশীলন করতে হয়। কিন' মেয়েরা ছোট ছিল বলে করা হয়নি।

অভিনয়ে হাতেখড়ি কার কাছে?

তখন 'নূরুল মোমেন' ছিলেন খুব বিখ্যাত অভিনেতা। তার হাতেই আমার নাটকের হাতেখড়ি হয়েছিল। তার সঙ্গে বহু নাটকে অভিনয় করেছি।

আপনার প্রথম কাজ কি?

DilaraZaman02 আমার প্রথম কাজ 'মামলার ফল'। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। স্কুলে পড়ি। তারপর কলেজ জীবন পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি, মানে '৬৩ সালে 'ডাকসু'র একটি নাটকে অভিনয় করি। নাটকটি ছিল আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখা 'মায়াবী প্রহর'। ওখানেই প্রথম আমার সাথে আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচয়।

আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতি যদি কিছু বলেন...।

মামুনের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। আমরা একসাথে শেষ কাজ করি আফসানা মিমির পরিচালনায় 'গৃহগল্প' সিরিয়ালে। এরপর এটিএন বাংলার একটি অনুষ্ঠানে একত্রে বিচারক ছিলাম। এতো কাছের মানুষ যে এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে ভাবতেও পারিনি।

আবদুল্লাহ আল মামুনের মতো নাট্যব্যক্তিত্বদের প্রয়াণে এদেশের নাট্যাঙ্গনের উপর কোন প্রভাব পড়বে কি?

প্রভাব তো অবশ্যই পড়বে। এই যে জিয়া হায়দার, সেলিম আল দীন-এরা সবাই বাংলা নাটককে ধরে রেখেছিলেন। জিয়া হায়দার আমার ও আমার স্বামীর বন্ধু ছিলেন। তার বাসাতেই আমার বিয়ে হয়েছিল। এরা নাট্যাঙ্গনে একটা নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন।

এবার বলুন, বেশিরভাগ নাটকে আপনি মা অথবা দাদীর চরিত্রে অভিনয় করেন কেন?

তো কি হব! এই ৬৬ বছর বয়সে আমি ছুকড়ি তো হতে পারি না। তাছাড়া আমি তো ভিন্ন চরিত্রও করি। কেউ কেউ আমাকে নাট্যাঙ্গনের 'জাতীয় মা' বলে। আমি বলব, এটা আমার ভাগ্য!

এখন কি কি কাজ করছেন?

আমার হাতে এখন অনেক কাজ। আবু আল সাঈদের ধারাবাহিক 'লোকালয়'-এ কাজ করছি। এটা দেখাবে দিগন্ত টিভিতে। ইদ্রিস হায়দারের ধারাবাহিক 'দুলাভাইয়ের প্রথম জন্মদিন'-এর শুটিং চলছে। তাহের শিপনের সিরিয়াল 'সাদা মেঘ কালো মেঘ'-এ কাজ করছি। ঈদে ৯টি নাটকে কাজ করছি। আরো কাজ করতে পারি।

অবসর কিভাবে কাটান?

অবসরই তো পাই না। সারাক্ষণই কাজ করি। বাইরের কাজের পর ঘরে এসে আবার ঘরের কাজ শুরু করি। এখানে (উত্তরায়- যেখানে তিনি থাকেন) জিনিসপত্রের অনেক দাম। মাঝে মাঝে কারওয়ান বাজার থেকে বাজার করে আনি। ঘরের সব রান্না-বান্নাও নিজেই করি। আমি অন্যের রান্না খেতে পারি না।

ব্যাক্তিগত জীবন সম্পর্কে বলুন...।

লিখে দাও আমি এক নিঃসঙ্গ মা। আমার দুটি মেয়ে। কিন্তু একটাকেও কাছে পাই না। একজন আমেরিকায় অন্যজন থাকে জাপানে। যদি কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে না পারতাম তাহলে নিশ্চিত মারা যেতাম। উনি (স্বামী) তো অন্য ধরণের মানুষ। সারাক্ষণ খেলা দেখা, লেখালেখি আর বই পড়া! আমি আবার অন্য সবার মত ঘোরাঘুরি পছন্দ করি না। বাইরে কাজ থাকলে কাজে যাই, নয়তো বাসার কাজ করি। সবাই আমাকে খুবই অপন করে নেয়। এটা আমার খুবই ভাল লাগে।

অপনার প্রিয় শিল্পী কে?

সবাই প্রিয়, অপ্রিয় বলতে কেউ নেই। একেক জন একেক রকম অভিনয় করে। সবাই-ই খুব ভাল কাজ করে।

নিজের অভিনয় আপনার কেমন লাগে?
আমার অভিনয় আমার ভাল লাগে না। কেমন জানি একঘেয়ে অভিনয় করি। কোনো বৈচিত্র্য নেই (একথা বলেই তিনি হাসতে শুরু করেন)।

এই দীর্ঘ অভিনয় জীবনের কোনো মজার স্মৃতি বলবেন?

সবই তো মজার স্মৃতি। এক একটি একেক রকম মজার। তারপরও এখন যেটি মনে পড়ছে সেটা হলো- একবার হুমায়ূন আহমেদের একটি কাজে আমি অভিনয় করতে আউটডোরে গিয়েছি। ওখানে একটি শর্টে খাবার পরিবেশন ছিল। সব খাবারই বাইরে থেকে আনা। তো আমার একজন সহ অভিনেতা পানি মনে করে কেরোসিনের একটি বোতল থেকে কেরোসিন মুখে দিয়ে দিল। মুখে দেবার পর বেচারার তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস'া। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ মুখ কালো করে মুখ থেকে গড়গড় করে বের করে চারপাশে একেবারে কেরোসিন ছিটিয়ে ফেলে দিল। কিন্তু অসতর্কতাবশত সব গিয়ে পড়ল খাবারের মধ্যে। কিন্তু ওখানে আর খাবার পাওয়া যাবে না যারা ঘটনাটা দেখে ফেলেছে তারা সবাই ব্যাপারটা পুরোপুরি চেপে গেল।তারপর যখন শর্ট শুরু হলো তখন আমি সবার প্লেটে খাবার তুলে দিতে শুরু করলাম। কিন্তু মুখে নেবার পর সবার অবস্থা খারাপ! এদিকে ক্যামেরা চলছে- না পারে ফেলতে, না পারে গিলতে। সবার মুখের অবস্থা যে কি রকম হয়েছিল না দেখলে বোঝানো যাবে না।
শর্ট শেষে তো সবাই চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিল। তখন অবশ্য আসল ঘটনা ফাঁস হয়ে গেল।

ছোটবেলা সম্পর্কে কিছু বলুন।

আমার দেশের বাড়ি লক্ষীপুরে। তবে জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। ১৯৪৩ সালের ১৯ জুন আমার জন্ম। ছোটবেলা কেটেছে আসানসোলে। দেশবিভাগের পর কেটেছে যশোর ও তারপর ঢাকায়। ছোটবেলায় মা চাইতেন, আমি যেন গান অথবা নাচ করি। কিন্তু রেডিওতে নাটক শুনতে শুনতে নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। তখন মনে মনে ভাবতাম, এই ধরণের কিছু করব।

নাটকে এলেন কিভাবে?

স্কুলে যখন পড়ি তখনই একটি নাটক করি, আগেই বলেছি। নাম ছিল 'মামলার ফল'। তারপর কলেজ জীবন পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে একটু সুযোগ পাই কিছু করার। তখন তো ছেলে-মেয়ে একসাথে কাজ করা যেত না। আমার মনে আছে, তখন শহীদ মুনীর চৌধুরী স্যার আমাকে তার নাটকে কাজ করানোর জন্য আমার বাবাকে চিঠি দিয়েছিলেন। যাতে তিনি অনুমতি দেন। বাবা অবশ্য অনুমতি দিয়েছিলেন।তারপর তো বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর স্বামীর প্রেরণায় কাজ করতে থাকি। '৬৭ সাল থেকে '৮০ সাল পর্যন্ত ঢাকার বাইরে থাকায় কাজ করতে পারিনি। ঐ সময় অমরা ময়মনসিংহ আর চট্টগ্রামে থাকতাম। তারপর ঢাকায় এসে আবার '৮২ সাল থেকে টেলিভিশনে কাজ শুরু করি।

মঞ্চে আপনাকে আবার দেখা যাবে?

এখন আমাদের বয়সের তো কাউকে দেখি না মঞ্চে। আর এখন এত সময় নিয়ে দীর্ঘ সময় অনুশীলন করার মত শক্তি, সাহস কোনোটাই নেই। তারপরও যদি কেউ ডাকে আর সময়-সুযোগ পাই তাহলে অবশ্যই মঞ্চে কাজ করবো ।

সুত্র - গ্লিটস/১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮

No comments:

Post a Comment