টেনশনে আমার ঘুম নেই: ইমন
খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এই ছেলেটি এক সময় জাতীয় দলের ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন দেখতো। লাজুক টাইপের, জেদী এই নবীন আমাদের ছবির জগতে নতুন দিনের বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে। এবার ইমনের গল্প। তার মুখোমুখি হয়েছেন মীর সামী।
'একবুক ভালোবাসা' ছবি সম্পর্কে বলুন।
'একবুক ভালোবাসা' নায়ক হিসেবে আমার প্রথম ছবি। এবারের ঈদে ছবিটি মুক্তি পাবে। ফলে টেনশনে আমার ঘুম নেই। উঠতে, বসতে, খেতে এবং ঘুমাতে যাবার সময়ও আমি 'একবুক ভালোবাসা'র কথা চিন্তা করি। সারাক্ষণ কায়োমনোবাক্যে প্রার্থনা করি, আমার ছবিটি যেন ভালোভাবে দর্শক গ্রহণ করেন। আর আমি বিশ্বাস করি, আমার ছবিটি একবার দর্শক দেখলে পছন্দ করবেনই। কারণ এই ছবির সাথে জড়িত সবাই-ই অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছেন। আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি যে, অনেক ভালোবাসা দিয়ে যে কাজই করা হয় না কেন সেটা সফল হবেই।আমরা জানি, প্রথম ছবি 'দারুচিনি দ্বীপ'-এ ভালো অভিনয়ের পর অনেক পরিচালকই আপনাকে ছবিতে কাজ করার অফার দিয়েছেন। কিন্তু এতো পরিচালক থাকতে ইস্পাহানী আরিফ জাহানের সাথে কাজ করতে আগ্রহী হলেন কেন?
ইস্পাহানী আরিফ ভাইদের সঙ্গে আমার যেদিন পরিচয় হয় সেদিন তাদের ব্যবহারে আমি দারুণ মুগ্ধ হয়েছি। আমি যখন ছবিতে অভিনয় করতাম না তখন লোকমুখে শুনতাম, আমাদের দেশের এফডিসির পরিচালকদের মন-মানসিকতা সেকেলে টাইপের। কিন্তু তাদের এবং সোহানুর রহমান সোহান ভাইয়ের সাথে কথা বলে আমার কখনো মনে হয়নি, তাদের মানসিকতা সেকেলে। বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে এসে আমার সেই সময়ে জন্ম নেওয়া ধারণাটা পাল্টে গেল। আর আমি মনে করি, এফডিসির সবার ব্যবহারই আমার ভেতরে এই বোধ জন্ম দিয়েছে। তারা আমাকে যেভাবে গ্রহণ করেছেন তাতে আমি তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।ছবির ভুবনে কিভাবে এলেন?
'০৬ সালের কথা। আমি তখন বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে কাজ করে কিছুটা পরিচিতি পেয়েছি। একদিন চ্যানেল আইয়ের ইবনে হাসান খান আমাকে ডেকে বললেন, "ইমন, তুমি আমাদের নতুন ছবি 'দারুচিনি দ্বীপ'-এ অভিনয় করবে? এটি পরিচালনা করবেন তৌকির আহমেদ।" এই প্রস্তাবের পর আমি কোনোকিছু না ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। 'দারুচিনি দ্বীপ'-এ আমি সঞ্জু চরিত্রে অভিনয় করেছি। এই চরিত্রটি করার পরে আমার পরিচিতি আরো বেড়ে গেল। তখন আমি রাস্তায় বেরুলেই হলেই সবাই জানতে চাইতো, "আপনি দারুচিনি দ্বীপের সঞ্জু না?" এই ব্যাপারটায় আমার খুব মজা লেগেছে। এরপর এফডিসির অনেক পরিচালকই আমাকে নিয়ে ছবিতে অভিনয়ের অফার দিয়েছেন। তবে আমি সময় নিয়েছি। কারণ আমি জানতাম, নিজেকে নায়ক হিসেবে দেখতে হলে অনেক কিছু পারতে হবে। এই সময়টুকুর মধ্যে আমি নিজেকে তৈরি করেছি। তারপর পরিচয় হলো ইস্পাহানী ভাইয়ের সাথে। তিনি আমাকে তার নতুন ছবির গল্পটি বললেন এবং জানালেন আমার নায়িকা হবেন অপু বিশ্বাস। আর আমিও রাজি হয়ে গেলাম। আমার মনে হয় ছবিতে কাজ করব বললেই হয় না।নাটকেও তো অভিনয় করেছেন। নাটক, সিনেমার মধ্যে পার্থক্য কী?
নাটক এবং সিনেমা দুটো পুরোটাই আলাদা মাধ্যম। ছবির সবকিছুতেই একটা ফিল্মি ভাব থাকতে হবে। আমি 'একবুক ভালোবাসা' ছবিতে কাজ করতে গিয়ে প্রোডাকশন বয় থেকে শুরু করে ছবির পরিচালক-সবার কথা বোঝার চেষ্টা করেছি। আর যেটা শেখার প্রয়োজন ছিল সেটা হলো নাচ এবং মারপিট জানা। একসময় আমি বাংলা ছবি দেখে হাসতাম। কারণ, সেই সময়ের নায়কদের নাচ-মারপিট ছিল হাস্যকর। কিন্তু ফিল্মে এসে বুঝলাম, নাচ এবং মারামারি কতোটা কঠিন সেটা বলে বোঝানো যাবে না। এই ছবির নাচ এবং মারপিটে আমি যদি কোনো কৃতিত্ব দেখিয়ে থাকি, তার পুরোটাই পাবেন নৃত্য পরিচালক মাসুম বাবুল ও অ্যাকশন ডিরেক্টর আরমান ভাই।বলুন তো মিডিয়াতে কিভাবে এলেন?
আগে আমরা থাকতাম মুগদাপাড়া। একদিন নটরডেম কলেজে খেলতে গিয়েছি। তখন কলেজে একটি বিজ্ঞাপনের শুটিং হচ্ছিল। পরিচালক তারিক আনাম খান। আমি তাকে আগে টেলিভিশনে দেখেছি। ঐ সময় কলেজে উপস্থিত আমার এলাকার এক ছোট ভাইয়ের মা তারিক আনাম খানের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি আমার সামনেই তাকে বলেন, "এই ছেলেকে দিয়ে আপনি মডেলিং করাতে পারেন।" তখন তারিক আনাম আমাকে তার সাথে দেখা করার জন্য একদিন আমাকে পাবলিক লাইব্রেরিতে আসতে বললেন। তার সাথে দেখা করার দিন, তারিখ এখন মনে নেই। যাই হোক, আমার মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করতে থাকলো।তারপর কী হলো?
পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি, সেখানে আরো অনেক ছেলে-মেয়ে হাজির। আমাদের দুটো দলে ভাগ করা হলো। আমি যে দলে পড়লাম, সেটার সবাই ভাবতে শুরু করলাম যে, আমাদের বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরে তারা জানালেন, আমাদেরকে নির্বাচন করা হয়েছে। ওফ, কি যে ভালো লেগেছিল!ওখানে আমার সাথে আরো কয়েকটি ছেলের পরিচয় হয়েছিল। তবে তাদের সাথে আমি আর কোনো যোগাযোগ করিনি। হঠাৎ একদিন তারিক আনাম খানের বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে পরিচয় হওয়া একটি ছেলে ফোন করে বললো, আমি যেন নিজের কিছু ছবি বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থায় জমা দিয়ে আসি। তখন আমার একটিও ভালো ছবি তোলা ছিল না। ফটোসেশন যে করব সে টাকাটাও কাছে নেই। উপায়ান্তর না দেখে বাসায় আম্মুকে সমস্যার কথাগুলো বললাম। তারপর বাবা -মাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে চঞ্চল মাহমুদের কাছে হাফরিল ছবি তুলি। সেই ছবিগুলো জমা দিলাম, এশিয়াটিক আর মাত্রা'য়। এরপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লাম পড়ালেখা নিয়ে।
হঠাৎ একদিন বাংলার মেলার এমদাদ ভাই (এমদাদ হক, ডিজাইনার) আমাকে ফোন করে বললেন, "আফজাল ভাইয়ের (আফজাল হোসেন, মাত্রার প্রধান) কাছে আমার ছবি দেখে পছন্দ হয়েছে।" তিনি আমাকে তার সাথে কাজ করতে প্রস্তাব দিলেন। আমি কিন্তু তাকে তখন চিনি না। যাই হোক, আমি তার অফিসে গেলাম। ওখানে যাবার পর দেখলাম, এখন যারা র্যাম্প কাঁপিয়ে বেড়ান তারা অনেকেই হাজির। তারপর সেদিন আমি বাংলার মেলার ডিজাইনে কয়েকটি পোশাকের মডেল হলাম। এই ফটোশুটের কয়েকটি ছবি ছাপা হয় ডেইলি ষ্টারের ফ্যাশন ম্যাগাজিনে। ম্যাগাজিনটা দেখার পর আমার মনের মধ্যে এক রকমের ভালো লাগা কাজ করতে থাকে। এরপর থেকে আমি সিরিয়াসলি মডেলিংয়ের চিন্তা করলাম।
ম্যাগাজিনের ছবি দেখে বিজ্ঞাপন নির্মাতা শাহরুখ আমিন টিংকু আমাকে ফোন করে বলেন, "একটা বিজ্ঞাপনের শুটিং করব কলকাতায়। তোমার পাসর্পোট আছে?" তখন আমার পাসর্পোট ছিল না। অনেক কষ্ট করে পাসপোর্ট বানালাম এবং জীবনের প্রথম বিজ্ঞাপনের শুটিং করলাম কলকাতায়। পণ্যটি ছিল তিব্বত সেন্ডেলিনা পাউডারের। কলকাতাতে আমরা ৫ দিন ছিলাম।
যদি নায়ক বা মডেল না হতেন তবে কী হতেন?
যদি নায়ক না হতাম তাহলে ক্রিকেটার হতাম। কারণ আমরা যখন মুগদা থাকি তখন একটা ক্রিকেটের দল করেছিলাম এলাকার বন্ধুরা মিলে। দলের নাম 'ড্রিমল্যান্ড'। আমরা বন্ধুরা স্বপ্ন দেখতাম একদিন বাংলাদেশের ন্যাশনাল টিমে খেলব। জানেন, তখন আমি খুব ভালো ব্যাটিং করতাম। কিন্তু ফিল্ডিংয়ে খুব খারাপ ছিলাম। একবার আমরা খেলতে গিয়েছি। যেখানে অনেক মেয়ে দর্শক ছিল। তাদের দেখে আমি তো ইচ্ছে করেই মাঠের মধ্যে লাফালাফি করতে শুরু করলাম। আর এই লাফাতে লাফাতে হঠাৎ একটা বল এসে আমার হাতের তালুতে জমা হয়ে গেল! আর এটা দেখে সবাই ভাবতে শুরু করলো, "জন্টি রোডস এসে গেছে।" পরে আমি ড্রিমল্যান্ডের ক্যাপ্টেনও হয়েছিলাম।কিছুদিন আগে খবর বেরিয়েছিল ইমন বিয়ে করেছেন! আসলেই কি বিয়ে করেছেন?
প্রথমতঃ আমি বিয়ে করেছি- এই খবরটা ছিল একটা মিথ্যা খবর। আমি চলচ্চিত্রে এসেছি এটা অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। তারাই গুজব ছড়িয়েছেন, আমি বিয়ে করেছি। পরে অবশ্য আমি প্রতিবাদ করায় তারা সংশোধনী ছেপেছেন।
সত্যি করে বলুন-কবে বিয়ে করবেন?
বিয়েটা পুরোপুরি নির্ভর করে খোদার উপরে। তবে বিয়ে করব নিশ্চিত এবং সেটা সবাইকে জানিয়েই করব।কেমন পাত্রী পছন্দ?
অসম্ভব রূপবতী হতে হবে এমন নয়। আমি তাকেই বিয়ে করব যে আমাকে বুঝবে, আমিও তাকে বুঝব। আর তার মনটা হতে হবে অনেক বেশি সুন্দর।প্রেম করছেন?
হ্যা, তবে কোন মেয়েকে আমি ভালোবাসি না। আমি প্রেম করি আমার কাজের সাথে।আপনার তো প্রেমপত্র পাবার কথা! আপনি দেখতে হ্যান্ডসাম...।
প্রেমপত্র জীবনে কখনো পাইনি -এটা বলব না। ...প্রেমপত্র নিয়ে আমার একটা আমার একটা মজার অভিজ্ঞতার গল্প বলি। শান্তিনগরে এক স্যারের কাছে তখন অংক শিখতাম। দশজনের ব্যাচে ছেলে আমরা মাত্র তিনজন। বাকি সাতজনই মেয়ে। এই সাতটা মেয়ের কাছে থেকেই আমি এক সপ্তাহে সাতটা চিঠি পেয়েছিলাম। পরে অবশ্য ভয়ে সেই স্যারের কাছে আর পড়তে যাইনি!এবারের ঈদে আপনার কোনো নাটক প্রচারিত হবে?
না। আমি আমার অসংখ্য ভক্তদের জন্য এবার ছবিতে অভিনয় করছি। আমার বিশ্বাস তারা হলে গিয়ে আমার ছবি দেখবেন, আমাকে দেখবেন। নাটক পুরোপুরি বাদ দেইনি। তবে এ মাসে ছবির কাজ নিয়ে দারুণ ব্যস্ত থাকায় নাটকে অভিনয় করা হয়ে ওঠেনি।কতোদূর যেতে চান?
আমি নিজেকে একজন ভালো অভিনেতা হিসেবে দেখতে চাই। লোকে যেন আমাকে দেখে বলে, "ইমন অনেক ভালো অভিনয় করে"।এবার নিজের বাবা-মা, ভাই-বোনদের নিয়ে বলুন।
আমার জন্ম হয় ঢাকার গোপীবাগে। বাবার নাম আব্দুল বাসেদ মিয়া আর মা মাসুদা আক্তার। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। ফলে আমি খুব আদরে বড় হয়েছি। ছেলেবেলা থেকেই আমি খুব জেদী টাইপের। পাঁচ কী ছয়মাস বয়সে আমরা গোপীবাগ থেকে আমরা মুগদা চলে আসি। আমার প্রথম স্কুল 'মুগদাপাড়া মান্ডা স্কুল'। এখান থেকে এইচএসসি পাশের পর ভর্তি হই ঢাকা সিটি কলেজে। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে অনার্স করি ম্যানেজমেন্টে। এখন স্টামফোর্ড ইউনির্ভাসিটিতে এমবিএ পড়ছি। ছোট্টবেলায় আমি খুব লাজুক টাইপের ছিলাম।
সুত্র - গ্লিটস/৪ ডিসেম্বর ২০০৮
No comments:
Post a Comment