চঞ্চলা স্বাগতা
"আমি খুবই চঞ্চল। বকবক করতে ভালোবাসি। সাজগোজ খুব একটা করি না। এজন্য অনেকেই আমাকে পাগলী বলে।" নিজের সম্পর্কে এভাবেই পরিচিতি দিলেন মডেল অভিনেত্রী জিনাত সানু স্বাগতা।কয়েকদিন আগে এক নাটকের শুটিং স্পটে বসে ধুম আড্ডা হচ্ছিল স্বাগতার সাথে। একাধারে গায়িকা, অভিনেত্রী, মডেল তিনি। পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা স্বাগতা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন গান গাইতে। বাবা খোদা বখস শানু একজন সঙ্গীত শিক্ষক। একসময় শিল্পকলা একাডেমীতে চাকুরি করতেন। এখন ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে নিজেই খুলে বসেছেন সঙ্গীতের স্কুল। তাই জন্মের পর থেকেই স্বাগতার কণ্ঠে খেলেছে সা রে গা মা...
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম এন্ড মিডিয়া বিভাগের ছাত্রী স্বাগতা। ২০০৫ এর কথা। আবদুল্লাহ আল মামুন তাদের শিক্ষক। তখন এটিএন বাংলায় এই নাট্যকারের 'বাবা' ধারাবাহিকটি শেষ হয়েছে। তিনি 'এক জনমে' নামে আরেকটি নাটকের কাজ শুরু করবেন। স্বাগতাকে সেটাতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। স্বাগতার কথায়, "আমাকে মামুন স্যার কেন যে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন এখনো বুঝতে পারি না। কারণ আমি মোটেই সাজতাম না। থাকতাম কেয়ারলেস হয়ে। প্রস্তাব পাওয়ার পর তাঁকে বললাম, আমি কি অভিনয় পারব! তিনি বললেন-আমার মধ্যে যে স্বাভাবিক চপলতাটা আছে সেটাই তার নাটকে দরকার। আমি একটু ভেবে রাজি হয়ে গেলাম।"
এভাবেই ছোট পর্দায় কাজ করা শুরু করলেন স্বাগতা। সেই সময়েই চলছিল 'ইউ গট দি লুক' এর অডিশন। স্বাগতার মায়ের ইচ্ছা মেয়ে তার কোন একটা সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিক। কিন্তু চপলা স্বাগতার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। বন্ধবী কণার পীড়াপীড়িতে শেষে রাজি হলেন ফটোসেশন করতে।
ফটোগ্রাফার অপূর্বকে দিয়ে ছবি তুলিয়ে বান্ধবী কণা সেই ছবি তুলে দিলেন উপস্থাপক আব্দুন নূর তুষারের হাতে। তুষার 'ইউ গট দি লুক' অনুষ্ঠানের ভিডিও নির্মাতা হিসেবে কাজ করছিলেন তখন। কয়েকদিন পর স্বাগতার মোবাইলে একটা ফোন এল। স্বাগতার কথায়, "আমি হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বললো, 'হ্যালো প্যান্টিন ওয়াই জি টি এল থেকে বলছি। ছবি দেখে আপনাকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়েছে। আগামীকাল আপনার অডিশন।' ফোন পেয়েতো আমি অবাক। আমার ধারণা ছিল প্রাথমিক বাছাইয়েই আমি বাদ পড়ব। যাই হোক পরদিন কণা আমাকে জোর করে চোখে কাজল দিয়ে সাজুগুজু করিয়ে দিল। তারপর তাকেই নিয়েই রওনা দিলাম অডিশন দিতে।"
এরপরের কাহিনী খুব সংক্ষিপ্ত। স্বাগতা শুধু প্রাথমিক পর্বেই উত্তীর্ণ হননি, ২০০৫ এর ইউ গট দি লুক এর 'বেস্ট লুক' নির্বাচিত হন তিনি। এদিকে 'এক জনমে' নাটকেও কাজ করছেন। বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপন চিত্রেও কাজ করলেন। তার উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞাপন চিত্রের মধ্যে আছে 'প্রাণ কোলা', 'স্ট্যান্ডার্ড চার্টাড ব্যাঙ্ক', 'ক্লোজআপ', 'কোকোলা নুডলস' ইত্যাদি।
এরপর আসলো বড় পর্দায় কাজ করার প্রস্তাব। নায়ক মান্না তার 'শত্রু শত্রু খেলা' ছবিতে অভিনয় করতে বললেন। প্রথমে একদমই রাজি ছিলেন না স্বাগতা। পরে মান্নার কঠিন অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। এদিকে আবদুল্লাহ আল মামুনও বলেন "ভালোই তো, কাজ করো মান্নার সাথে। ছেলেটা ভালো।" স্বাগতা বলেন, "আমার অবশ্য কাহিনী শুনেই ভালো লেগেছিল। তাই রাজি হয়ে গেলাম। আর আমি যেরকম, ছবির চরিত্রটাও ছিল সেরকম। সেজন্য বড় পর্দায় অভিনয় করতে গিয়ে আমার খুব একটা অসুবিধা হয়নি।"
তাছাড়া এটাই তার প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় নয়। শিশু শিল্পী হিসেবেও এর আগে স্বাগতা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ছবিগুলোর মধ্যে 'ছোটপুত্র' ও 'সন্ত্রাস' উল্লেখযোগ্য।
স্বাগতা কয়েকদিন আগে আরেকটি ছবির কাজ শেষ করেছেন। আর সেটা হল নায়ক রাজ রাজ্জাকের 'কোটি টাকার ফকির'। বর্তমানে এনটিভি'র 'ঢাকা নিবাস', চ্যানেল আইতে 'মনোরমা আরোগ্য নিকেতন' এ অভিনয় করছেন। এছাড়া এটিএন-এ 'সিনেবিট সাদা কালো' নামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের উপস্থাপনাও করছেন। তবে গান তিনি ছাড়েন নি। নিজের ব্যান্ড 'মহাকাল' নিয়ে মহা ব্যাস্ত আছেন।
স্বাগতার কাছে আমাদের প্রশ্ন ছিল, আপনি আসলে কোন মাধ্যমে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? গান নাকি অভিনয়?
স্বাগতা জবাব দেন, "সত্যি বলতে গানই আমার সব কিছু। ছোট বেলা থেকে গানের মধ্যেই বড় হয়েছি। '৯৫তে নতুন কুড়িতে অংশ নিয়েছি। তবে এখন অভিনয়টাও ভালো লাগছে।"
প্রথম বড় পর্দায় অভিনয় করতে গিয়ে কোন ভয় কাজ করেনি মনে?
স্বাগতা : ভয়! ভয় লাগবে কেন?
কারণ অনেকেইতো বলে চলচ্চিত্রের পরিবেশ খারাপ। সেকারণে বলছি...
স্বাগতা : দেখুন..ভালো খারাপ নিজের কাছে। কেউ যদি খারাপ হতে না চায় তাহলে কেউ তাকে জোর করে কিছু করতে পারে না। অন্তত আমি এটা বিশ্বাস করি। আর কাছে গিয়ে বুঝেছি এফডিসি মোটেই খারাপ জায়গা না।
প্রথম ছবি 'শত্রু শত্রু খেলা' মুক্তি পাওয়ার পর কেমন লেগেছিল?
স্বাগতা : ভালোলাগার চাইতে মজা পেয়েছিলাম বেশি। মুক্তি পাওয়ার পর একদিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে অভিসার সিনেমা হলে গেলাম ছবিটি দেখতে। সঙ্গে আমার বন্ধুরাও ছিল। ছবি শেষে যখন বেরিয়ে আসছি তখন দর্শকরা আমাকে চিনে ফেললো। কত কী যে বললো আমাকে নিয়ে। কেউ বললো খুবই ভালো হয়েছে। কেউ বললো আপনার চুল আর হাসিটা চমৎকার। ছবিতে আমার চরিত্রটা ছিলো খল নায়িকার। একজনতো বলেই বসলো - তুমি যতই ছলচাতুরি কর মান্নাকে কখনও মৌসুমীর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে পারবে না। ওই ছবিতে আমার সহশিল্পী ছিলেন মান্না আর মৌসুমী।
ইমেজ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে প্রথম ছবিতে কেউই খল নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে চান না। আপনি কেন রাজি হলেন?
স্বাগতা : আমি এসব বিশ্বাস করি না। কাজ দিয়েই মানুষ মানুষকে বিচার করে। এক ছবিতে খল নায়কার কাজ করেছি। আরেক ছবিতে অন্য কোন চরিত্রে কাজ করব। আসলে নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে কাজ করতে আমার ভালো লাগে।
বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিল্পীই নাকি কাজ পাওয়ার জন্য পরিচালকদের সাথে বিশেষ খাতির রাখেন। এই প্রজন্মের একজন শিল্পী হয়ে এ বিষয়ে আপনার কি মন্তব্য?
স্বাগতা : দেখুন এই ব্যাপারটা শুধু মিডিয়াতেই নয়, সব জায়গাতেই খাটে। তবে আমি বিশ্বাস করি যদি কেউ ভালো কাজ না পারে তাহলে যতই পরিচালক প্রযোজকদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখুক না কেন, তাতে কোন লাভ হবে না। কারণ দর্শক-শ্রোতারা যদি আমাকে, আমার অভিনয় বা গান পছন্দ না করে, তাহলে ওই খাতিরয়ালা প্রযোজক পরিচালকরাই আমাকে আর নেবেন না।
আপনার দ্বিতীয় ছবি 'কোটি টাকার ফকির' নিয়ে কিছু বলুন।
স্বাগতা : তেমন কিছু বলার নেই। শুধু আশা করি দর্শরা এই ছবি দেখেও প্রথম ছবিটির মত আমাকে গ্রহণ করবেন। তবে রাজ্জাক আঙ্কেল অসাধারণ একজন মানুষ। তার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।
শো বিজ অঙ্গনে আপনি কখনও কোন অসুবিধার সম্মুখিন হয়েছেন কী ?
স্বাগতা : সত্যি বলতে না। তাছাড়া আমি সবসময় আবদুল্লাহ আল মামুন, মান্না ভাইয়ের গাইডে ছিলাম। তারাই আমাকে গাইড করেছেন।
আপনি অনেক কম কাজ করেন। এর কারণ কী?
স্বাগতা : বলতে পারেন যোগাযোগের অভাব। আমি কাজের জন্য ছুটি না। কাজ সামনে আসলে পছন্দ হলে করি। আসলে একটু পাগলী ধরনেরতো, তাই নিজের মত থাকতে পছন্দ করি।
পাগলী মানে? বলেন কী!
স্বাগতা : হি.. হি.. হি.. হি.. না না .. ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আসলে নায়িকা হতে হলে যে গুণ থাকতে হয় তা আমার একেবারেই নেই। সাজগোজ করতে আমার একদম ভালো লাগে না। 'ইউ গট দি লুক' এ আমি প্রথম মুখে মেক আপ দেই। ফারজানা আপা আমাকে এত সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন যে, তখনই আমি বুঝতে পারি আমার চোখ দুটো কত সুন্দর। এমনকী যে দিন ছবি তুলেছিলাম 'ইউ গট দি লুক' এর জন্য সেদিন তো বান্ধবী কণা আমাকে জোর করে চোখে কাজল দিয়ে দিয়েছিল। এখনতো তাও চোখে কাজলটা দেই। আগে তাও দিতাম না। আফটার অল নায়িকা না.. একটু সাজ তো দিতেই হয়.. হা.. হা.. হা..।
ব্যান্ড 'মহাকাল' এর কী অবস্থা?
স্বাগতা : বেশ ভালো। মিশ্র অ্যালবাম 'স্বপ্নচূড়া - ৩'-এ আমাদের গান প্রকাশিত হয়েছে। শ্রোতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়েছি। ইচ্ছে আছে এই বছরে আমাদের ব্যান্ডের অ্যালবাম বের করব।
এই বছরের কবে?
স্বাগতা : ভাই ব্যান্ডের ছয়জন সদস্য। ছয়শ রকম কাজে তারা ব্যস্ত। তাই এই বছর অ্যালবাম বের হবে এতটুকুই বলতে পারি। কবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না।
আপনিতো ফিল্ম এন্ড মিডিয়া নিয়ে পড়াশোনা করছেন। ভবিষ্যতে কী নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন?
স্বাগতা : ইচ্ছেতো অবশ্যই আছে। আসলে আমি ভেবেছিলাম গান নিয়েই এগিয়ে যাব। এরপর পড়ালেখা শেষ করে একেবারে নির্মাতা হিসেবে মিডিয়াতে আসব। মাঝখান থেকে হঠাৎ করেই হয়ে গেলাম নায়িকা।
তাহলে এখন ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
স্বাগতা : তাও ভালো এই প্রশ্ন করলেন। অনেকেই জিজ্ঞেস করে আমি মিডিয়াতে না আসলে কী করতাম। আসলে আমি মিডিয়াতই আসতে চেয়েছি। অভিনয়ে না আসলেও গান নিয়েই থাকতাম আমি। গানই আমার জায়গা। আমি এখানেই থাকতে চাই।
সুত্র - গ্লিটস/২০ মে ২০০৮
No comments:
Post a Comment